এস.এম.দেলোয়ার হোসাইন, নিজস্ব প্রতিবেদক :
বৈচিত্র্যপূর্ণ ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এক একটি ঋতুর রয়েছে এক এক রকম বৈশিষ্ট্য। বাংলার প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্যে এখন হেমন্তের মাঝামাঝি। দিনে মিষ্টি রোদ, ভোরে পাতায় শিশির বিন্দু, হালকা কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পুরোদমে শীত শুরু হবে। শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছে গ্রামের গাছিরা। শীতের আমেজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার গাছিরা খেজুরের রস আহরণের জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বাংলার ঘরে ঘরে শীতকাল মানেই অনেকটা পিঠাপুলির উৎসব। কদিন পরেই গাছ থেকে গাছিদের প্রক্রিয়াজাত করা খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা হবে চিড়ার মোয়া, গুড় ও পাটালি। শীতের সকালে গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে খেজুরের রস দিয়ে বানানো হবে মুখরোচক পিঠা, পায়েস, ক্ষীর।
উপজেলার সন্যাসীরচর, বন্দরখোলাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জমির আইল, রাস্তার পাশে এমনকি পুকুর পাড়ে সারি- সারি খেজুর গাছের ডাল কেটে পরিষ্কার করছেন। হাতে দা, কোমরে রশি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ তৈরি করছেন গাছিরা। এরই মধ্যে অনেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে নলি গাঁথাও শুরু করেছেন।
জানা যায়, হেমন্তের শেষেই শীতের ঠাণ্ডা পরশে গাছিরা খেজুরগাছ প্রস্তুত করেন। এভাবেই চলে কিছুদিন। ক’দিন পারে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে খেজুর গুড় তৈরির পালা, শুরু হয়ে চলবে বসন্তের শেষ নাগাদ পর্যন্ত। বিকেল বেলায় কাটা গাছে হাঁড়ি দেবেন গাছিরা। আবার সকালে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গেই রস সংগ্রহ করে গাছ থেকে নামবেন। সেই মনোলোভা দৃশ্য সত্যিই মোহনীয়। সে সৌন্দর্য স্পর্শে নয়, অনুভবের।
মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে খেজুর গাছের সম্ভাব্য আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৫৫ হেক্টর, খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ৫০০শ। রস বা সংগ্রহ করা হয় এমন গাছের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৮০০টি। রস সংগ্রহ করে এমন গাছি ছিলেন ৫২০ জন।
বন্দোরখোলা এলাকার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, কাঁচা রসের পায়েস খাওয়ার কথা এখনো ভুলতে পারি না। আমাদের নাতি-নাতনিরা তো আর সেই দুধচিতই, পুলি-পায়েস খেতে পায় না। তবুও ছিটে ফোঁটা তাদেরও কিছু দিতে হয়। তাই যে কয়টি খেজুর গাছ আছে তা থেকেই রস, গুড়, পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়।
গাছি আব্দুর রহমান বলেন, খেজুরের গাছ কমে যাওয়ায় তাদের চাহিদাও কমে গেছে। আগে এই কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চালাতেন। এমনকি আগে যে আয় রোজগার হতো তাতে সঞ্চয়ও থাকতো, যা দিয়ে বছরের আরো কয়েক মাস সংসারের খরচ চলতো। বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, তাতে এক সময় হয়তো আমাদের দেশে খেজুর গাছ থাকবে না। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত তালগাছের মতো বেশি বেশি খেজুর গাছ লাগানো এবং তা যত্ন সহকারে বড় করা।
শিবচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, শিবচরে নদী ভাঙন, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার, নতুন করে চারা রোপণ না করাসহ বিভিন্ন কারণে খেজুরের গাছ অনেকটাই কমে গেছে। খেজুর গাছ একদিকে মাটির ক্ষয়রোধ করে অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষায় খুবই কার্যকর। ভোক্তারা যাতে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে প্রস্তুত খেজুরের রস-গুড় পেতে পারে এজন্য কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।
তিনি আরো বলেন, গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল, রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুমে আসার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে। খেজুরের রস আহরণে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত গাছিরা। সেখান থেকে গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরি করে নিকটস্থ বাজারে বিক্রয় করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়।
এই ওয়েবসাইটের সকল স্বত্ব madaripursomoy.com কর্তৃক সংরক্ষিত
Leave a Reply