ছোট থেকেই বাবা তোফাজ্জেল ফকিরের সঙ্গে চা বানাতেন আলতাফ মাহমুদ। চায়ের দোকানই ছিল তাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম। কিন্তু বছরের পর বছর চা বেচেও তাদের সংসারে ফেরেনি সচ্ছলতা। বিকল্প কিছু ভাবতে থাকেন আলতাফ। করোনার সময় ইউটিউবে কলকাতার তান্দুরি চা বানানোর কৌশল শিখে নেন। আর এই তান্দুরি চায়ের ব্যবসায় বদলে যায় জীবন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই লাভের মুখ দেখতে থাকেন আলতাফ। জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে চায়ের স্বাদের প্রশংসা। মাটির ছোট্ট কাপে তান্দুরি চা খেতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলতাফ মাহমুদ (২৮) মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটকচরের তোফাজ্জেল ফকিরের ছেলে। বাড়ির পার্শ্ববর্তী পেয়ারপুর বাজারে খুপরি দোকানে বাবা চা বানিয়ে বিক্রি করতেন। সেই বিক্রির টাকায় চলতো তাদের সংসার। সেই চায়ের দোকানে ছোট বেলা থেকেই বাবার সাথে চা বানাতেন আলতাফ মাহমুদ। ১৫ বছর ধরেই তিনি চায়ের ব্যবসা করে আসছেন। চার বছর আগে তার বাবা মারা যান। এরপর পুরো দোকানের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। বছরের পর বছর চা বিক্রি করেও ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পারায়, কি করা যায় এ নিয়ে নতুন করে ভাবনায় পড়েন আলতাফ।
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হয়। বেচাকেনাও কমে যায় আলতাফের। এরপর ঘরে বসে মোবাইলে ইউটিউবের মাধ্যমে কোলকাতার তান্দুরি চা বানানোর কৌশল শিখে নেন। মাদারীপুরের এ গ্রামের মধ্যে তান্দুরি চা বিক্রি হবে কি না তা নিয়েও দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়েন। ভাবেন একবার করে দেখি কী হয়। ২০২১ সালের প্রথম দিকে শুরু করেন তান্দুরি চায়ের ব্যবসায়।
দোকানের নাম দেন ‘আলতাফ তান্দুরি চা ঘর’। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে আলতাফের তান্দুরি চায়ের স্বাদের প্রশংসা। শীতের সময় লাইনে দাঁড়িয়ে এ চা খেতে হয়। প্রথম দিকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার চা বিক্রি হতো। এরপর আলতাফকে দেখে অনেকেই মাদারীপুরের মস্তফাপুর, রাজৈর, কালকিনিসহ বেশকিছু জায়গায় তান্দুরি চায়ের ব্যবসা শুরু করেন। তাই তার ব্যবসায় কিছু কমেছে। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টাকার তান্দুরি চা বিক্রি করেন। এতে করে মাসে তার দেড় লাখ টাকার চা বিক্রি হয়। তবে শীতের সময় প্রতিদিন ৭-৮ হাজার টাকার তান্দুরি চা বিক্রি হয়।
আলতাফ জানান- গরম পানি, চায়ের লিকার, কাজু বাদামের গুঁড়া, কালোজিরা, থ্রি ওয়ান চা, দুধের সর, ট্যাংক, চিনি, গুঁড়া দুধ, তরল দুধ, ওভালটিন, চকলেটের গুঁড়াসহ প্রায় ১০-১২ রকমের বিভিন্ন খাদ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করেন তান্দুরি চা। গরম চা মাটির তৈরি ছোট কাপে পরিবেশন করা হয়। পোড়া মাটির গন্ধে ভরপুর এ চা পান করতে বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চা পিপাসুদের লাইন লেগে থাকে। শুধু তান্দুরি চা নয়, এখানে আরও নানা ধরনের চা পাওয়া যায়। ‘চায়ের সঙ্গে কাপ চিবিয়ে খাবেন’ এই শিরোনামে চকলেট চা বিস্কুট কাপ ৫০ টাকা, চকলেট কপি বিস্কুট কাপ ৬০ টাকা, মাটির কাপে তান্দুরি চা ৩০ টাকা, তান্দুরি চকলেট চা ৫০ টাকা, কফি তান্দুরি চা ৫০ টাকা, পেপার কাপে দুধ চা ১০ টাকা, মালাই চা ২০ টাকা, কফি রেগুলার ৩০ টাকা ও গ্রিন চা ১০ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর থেকে আসা সানজিদা আক্তার বলেন, এখানে অনেকেই চা খেতে আসেন। বিশেষ করে তান্দুরি চায়ের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। তাই আমি প্রায় এখানে চা পান করতে আসি।
শহরের ১ নম্বর শকুনি এলাকা থেকে আসা তানমিরা বলেন, যখন ইচ্ছে হয়, তখন স্বামীর মোটরসাইকেলে এতদূরে এসে তান্দুরি চা পান করি। এ চায়ের খুব নাম আছে, তাই সুযোগ পেলেই পরিবারসহ এখানে চলে আসি।
আয়ান হাসান নামের ৯ বছরের এক শিশু জানায়, আমি মায়ের সঙ্গে প্রায় এখানে চা পান করতে আসি। তান্দুরি চায়ের মধ্যে চকলেট থাকে, তাই খেতে খুব ভালো লাগে।
স্থানীয় তানিয়া আক্তার বলেন, আলতাফের চা মানেই মজা। অনেক দূর থেকে এখানে চা খেতে মানুষজন আসেন। এছাড়া আমাদের গ্রামেও নতুন কেউ বেড়াতে এলে আলতাফের চা না খেয়ে যান না। আলতাফের চায়ের দোকানের জন্যই এ বাজারটা জমজমাট।
চা বিক্রেতা আলতাফ মাহমুদ বলেন, আমি ইউটিউব দেখে চা বানানো শিখে মাটির কাপে বিক্রি করছি। প্রথম দিকে আমি একা তান্দুরি চা বানালেও বর্তমানে অনেকেই এ চা বানিয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন। আর্থিক সংকটে লেখাপড়া খুব বেশি করা হয়নি। পরিবারের চাহিদা মেটাতে বাড়ির পার্শ্ববর্তী পেয়ারপুর ইউনিয়নের পেয়ারপুর বাজারে বাবার ছোট্ট চায়ের দোকানেই আজ আমার ভাগ্য বদল হয়েছে। শুধু চা বিক্রি করে পরিবারে সচ্ছলতা আনতে পারবো, তা কখনো ভাবিনি।
পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাবলু হাওলাদার বলেন, আমাদের পেয়ারপুর বাজারের আলতাফ তান্দুরি চা ঘরের অসাধারণ স্বাদের তান্দুরি চা প্রশংসার দাবিদার। এ চা কেন্দ্র করে আমাদের পেয়ারপুর বাজারটি জমজমাট থাকে। আলতাফ তার তান্দুরি চায়ের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে।
এই ওয়েবসাইটের সকল স্বত্ব madaripursomoy.com কর্তৃক সংরক্ষিত
Leave a Reply