মাদারীপুরসময় ডটকম ডেক্স :
আমার প্রথম জন্মদিন ছিল ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মায়ের মুখে শুনেছি, বাবা ঢাকা থেকে নতুন জামা নিয়ে আসবেন। সেই জামা পরে কেক কাটা হবে। কিন্তু বাবা আর আসেননি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আমার বাবা মারা গেছেন। তখন হয়তো কিছুই বুঝিনি। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর সব বুঝতে পেরেছি। আজও অপরাধীদের বিচার কার্যকর হয়নি। তাই সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের বিচার কার্যকর হোক। তাহলে এ ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের সাবেক যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সির মেয়ে নুসরাত জাহান মিথিলা।
শুধু মিথিলার পরিবার নয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত চার এবং আহত তিনজনের পরিবারের সদস্যরা কেউ ভালো নেই। আজও এসব পরিবারে শোক ও আতঙ্কের ছায়া কাটেনি। এ ঘটনায় আহতরা পঙ্গুত্ববরণ করে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম ও বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও পাগলপ্রায়। বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন তারা।
লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম বলেন, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজ আমরা নানা সমস্যার মধ্যে আছি। লিটনের বাবা ও আমি দুজনেই বয়স্ক মানুষ। আমরা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকি। লিটনের বাবা এখন কোনো কাজ করতে পারে না। আমি অপারেশনের রোগী, মাসে অনেক টাকার ওষুধ লাগে। ভাতা পাই তিন হাজার টাকা। খুবই কষ্টে দিন যাপন করছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, তিনি যেন একবারের জন্য হলেও আমার ছেলের কবর জিয়ারত করে যান, আর আমাদের একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেন।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালে লিটনের মেয়ে মিথিলার নামে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট এবং পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। এছাড়া প্রতি মাসে তার খরচ বাবদ পাঁচ হাজার করে টাকা দেন। মিথিলা মাদারীপুর শহরে তার নানার বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে আমাদের কাছে ফোন করে।
নিহত লিটন মুন্সির বাবা আইয়ুব আলী বলেন, আমাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছি। এখন আমাদের চোখের জল ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই সরকারের কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। রায় কার্যকরের দাবি জানাই।
নিহত লিটন মুন্সির একমাত্র মেয়ে মাদারীপুর সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান মিথিলা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় যখন আমার বাবা মারা যান তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম। বাবা কী জিনিস তা বুঝতে পারিনি। বাবার আদর পাওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছি।
শুধু লিটন মুন্সিই নন, ওইদিন মাদারীপুরের আরও তিনজন নিহত হন। তাদের একজন হলেন সাবেক শ্রমিক লীগ নেতা নাসিরউদ্দিন। তার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল গ্রামে।
নাছিরউদ্দিন থাকতেন ঢাকার হাজারীবাগে। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক সময়ে হাজারীবাগের শ্রমিক লীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাসির ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্ধভক্ত। তাই আওয়ামী লীগের মিছিল, মিটিং কিংবা সমাবেশ হলে প্রথম সারিতে থাকতেন, স্লোগান দিতেন। সেই প্রতিবাদী নাসির উদ্দিনকে জীবন দিতে হয় গ্রেনেড হামলায়।
গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত আরেকজন যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামে। বাকি নিহত সুফিয়া বেগমের বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামে। ওইদিন মহিলা লীগের নেতাদের সঙ্গে প্রথম সারিতেই ছিলেন তিনি। নিহত সুফিয়া সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহতরাও ভালো নেই। তারা পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবনযাপন করছেন। এমনই একজন আহত কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মাদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদার। তার একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে। শরীরের মধ্যেও অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় দিন পার করছেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হালান হাওলাদার বলেন, ২১ আগস্ট অনেক শখ করে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতে যাই। হাজারো মানুষ ঠেলে মঞ্চের খুব কাছাকাছি আসতেই বোমার বিকট শব্দ হয়। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখনো দুই হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় বেঁচে আছি।
তিনি বলেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর স্প্লিন্টার। প্রায় সময় স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা অসহ্য লাগে। সে কারণে তেমন কাজ করতে পারি না। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। তিন মাস পর পর ৩৯ হাজার টাকা পাই। তা দিয়েই সংসার ও ওষুধসহ যাবতীয় খরচ চালাতে হয়।
হালান হাওলাদার আরও বলেন, আগস্ট মাস আসলে দুই চোখের পানি যেন আর বন্ধ হয় না। সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারি না। আমরা যারা আহত প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন তা হলে ভালো হতো। আহত অনেকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ফ্ল্যাট পেয়েছেন। আমি পাইনি। আমার থাকার জন্য স্থায়ী বসত ঘরের প্রয়োজন।
আরেক আহত কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের ওয়াহেদ সরদারের ছেলে সাইদুল হক সরদার। তিনি শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করছেন। বাঁচার তাগিদে শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে বিদেশ গেলেও শরীরে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে সেখানেও কিছু করতে পারেননি। ফিরে আসতে হয়েছে দেশে।
সাইদুল হক সরদার বলেন, শুরুতে মঞ্চের অনেক পেছনে ছিলাম। শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য ধীরে ধীরে মঞ্চের ১০ থেকে ১২ হাত দূরত্বে চলে আসি। দাঁড়িয়ে মন দিয়ে নেত্রীর বক্তব্য শুনতে থাকি। বক্তব্য প্রায় শেষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেনি তার মধ্যে বোমা ফাটানোর শব্দ। পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণে শব্দ পেলাম। চারদিকে কালো ধোঁয়া। মানুষজনের আর্তনাদ, ছোটাছুটি। আমিও কোনো কিছু না বুঝে দৌড় দিতে যাবো ঠিক তখনই তৃতীয় বোমাটি বিস্ফোরণ হয়। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। বুঝতে পারি অসংখ্য মানুষ আমার শরীরের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ভাবিনি বেঁচে যাবো। বর্তমানে শরীরে যে যন্ত্রণা এর চেয়ে সেদিন মৃত্যুই ভালো ছিল।
আহত সাইদুল হক সরদার আরও বলেন, শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকর জীবনযাপন করছি। শরীরে স্প্লিন্টার যন্ত্রণায় তেমন ভারী কাজ করতে পারছি না। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেন উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমি উন্নত চিকিৎসা কীভাবে করবো। এত টাকা-পয়সা তো আমার নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, তিনি যেন আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। যাতে শরীর থেকে স্প্লিন্টার বের হয়ে যায়। বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন কাজকর্ম করেও ভালো কিছু করতে পারছি না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। তিন মাস পরপর ২৫ হাজার টাকা পাই। তা দিয়েই কোনোভাবে দিন চলে যাচ্ছে।
এছাড়া গ্রেনেড হামলায় কালকিনির কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের ডান হাত বাঁকা হয়ে গেছে। তিনিও কোনোরকমে দিনমজুরের কাজ করে বেঁচে আছেন।
কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. কায়েসুর রহমান বলেন, গ্রেনেড হামলায় আহতরা কে কোন অবস্থায় আছেন, সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা হবে।
সূত্র: জাগো নিউজ
এই ওয়েবসাইটের সকল স্বত্ব madaripursomoy.com কর্তৃক সংরক্ষিত
Leave a Reply